নিচের চিত্রটি লক্ষ কর। এটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক মানচিত্র। কাগজের এক পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমা, বাংলাদেশের কোন দিকে কোন দেশ, কোন সাগর ইত্যাদি এঁকে দেখানো হয়েছে। এছাড়া দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের সাতটি বিভাগ, কোন বিভাগে কতটি জেলা ও এদের নাম ও সীমানা। একটি মাত্র পৃষ্ঠার মধ্যে সারা বাংলাদেশের প্রশাসনিক সীমানা তুলে ধরা হয়েছে । এভাবে কাগজের এক পৃষ্ঠার মধ্যেই সময় পৃথিবী, বিভিন্ন মহাদেশ, বিভিন্ন দেশ বা কোনো দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা এঁকে দেখানো যায়।
এই মানচিত্র ছাড়াও তোমরা হয়তো তোমাদের স্কুলে দেয়াল মানচিত্র দেখেছ। তোমাদের ভূগোল ও পরিবেশ বইতে বা কোনো মানচিত্রের বইয়ে (এটলাসে) মানচিত্র দেখে থাকবে। মানচিত্র হলো একটি ছবি বা রেখাকন যা ভূপৃষ্ঠের কোনো ছোট বা বৃহৎ অঞ্চলকে উপস্থাপন করে থাকে। মানচিত্র কোনো অঞ্চল বা দেশের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, উদ্ভিদ, মাটি, পানি ও অনেক কিছু সম্পর্কে ধারণা দেয়। এর সাহায্যে আমরা বিভিন্ন মহাদেশ ও মহাসাগরের অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে পারি। মানচিত্রে একটি ছোট কাগজের মধ্যে অতি নিখুঁতভাবে বিভিন্ন বিষয়ের অবস্থা দেখানো যায়। এখন দেখা যাক মানচিত্র কী?
ইংরেজি 'map' শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ মানচিত্র। ল্যাটিন শব্দ 'mappa' থেকে 'mup' শব্দটি এসেছে। ল্যাটিন ভাষায় কাপড়ের টুকরাকে 'mappa' বলে। আগেকার দিনে কাপড়ের উপরই map বা মানচিত্র আঁকা হতো। পৃথিবী বা কোনো অঞ্চল বা এর অংশবিশেষকে কোনো সমতল ক্ষেত্রের উপর অরুন করাকে মানচিত্র বলে। মানচিত্র হলো নির্দিষ্ট ফেলে অক্ষরেখা বা দ্রাঘিমারেখাসহ কোনো সমতল ক্ষেত্রের উপর পৃথিবী বা এর অংশবিশেষের অঙ্কিত প্রতিরূপ। এই সমতল ক্ষেত্র হতে পারে এক টুকরা কাপড় বা কাগজ।
মানচিত্রে ফেল নির্দেশের পদ্ধতি (Methods of showing scale) : মানচিত্রে তিনটি পদ্ধতিতে ফেল নির্দেশ করা হয়।
ক) বর্ণনার সাহায্যে
খ) রেখাচিত্রের সাহায্যে
গ )প্রতিভূ অনুপাতের সাহায্যে
(ক) বর্ণনার সাহায্যে (By statement) : আমরা বর্ণনা বা করার মাধ্যমে মানচিত্রের ক্ষেল প্রকাশ করে থাকি। যেমন- ১ ইঞ্চিতে ৪ মাইল ১৬ ইঞ্চিতে ১ মাইল, ১ সেন্টিমিটারে ১ হেক্টোমিটার। এখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রথম ১ সংখ্যাটি (তা ইঞ্চি বা সেন্টিমিটার যাই হোক না কেন) মানচিত্রের দূরত্ব এবং দ্বিতীয় সংখ্যাটি (মাইল, গল্প, কিলোমিটার বা হেক্টোমিটার যাই হোক না কেন) ভূমির প্রকৃত দূরত্ব প্রকাশ করছে।
(খ) রেখাচিত্রের সাহায্যে (By graphical scale) : কোনো একটি রেখাকে প্রয়োজনীয় ইঞ্চি ৩ ইঞ্চির ক্ষুদ্র অংশে বা সেন্টিমিটারের ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে প্রতি ভাগের মান লিখে মানচিত্রের ভেল প্রকাশ করা যায়। যেমন- ১ সেন্টিমিটারে ১০ কিলোমিটার বর্ণনাটিকে রেখাচিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হলে প্রথমে সেন্টিমিটার একটি রেখা নিয়ে একে ৫ ভাগ করতে হবে, এর প্রতিটি ভাগ ১০ কিলোমিটার। বাম পাশে ১টি ঘর ছেড়ে নিয়ে যথাক্রমে ০, ১০, ২০, ৩০, ৪০ লিখে এর পাশে কিলোমিটার লিখতে হবে। বাম পাশের ঘরটিকে আবার ১০ ভাগে ভাগ (কারণ ১০ কিলোমিটারের ক্ষুদ্র ভাগ দেখাতে হবে) করে প্রতিটি ক্ষুদ্র ভাগের মান লিখতে হবে । যেমন-
ইঞ্চি ভেলের ক্ষেত্রে একই নিয়ম অনুসরণ করতে হবে (চিত্র ৩.২ খ)। এক্ষেত্রে ৩ ইঞ্চি দীর্ঘ একটি রেখা নিয়ে একে প্রথমে তিন ভাগ করতে হবে এবং বাম দিকের একটি ঘর ছেড়ে নিয়ে প্রতি ঘরের মান লিখতে হবে। বাম পাশের ঘরটিকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করতে হবে। ১ ইঞ্চিতে ৪ মাইল বর্ণনাটিকে চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করার সময় প্রথমে ৩ ইঞ্চি একটি রেখা নিয়ে একে তিন ভাগ করতে হবে। বাম দিকের একটি ঘর ছেড়ে দিয়ে যথাক্রমে ০.৪, ৮ মাইল লিখতে হবে। বাম পাশের ঘরটিকে আবার ৪ ভাগে (কারণ ১ ইঞ্চিতে ৪ মাইল) ভাগ করতে হবে। শূন্য থেকে বাম দিকে যথাক্রমে ১.২.৩.৪ মাইল লিখতে হবে।
(গ) প্রতিভূ অনুপাতের সাহায্যে (By representative fraction) : বিভিন্ন দেশের সূরত্ব পরিমাণের জন্য স্বতন্ত্র একক ব্যবহার করা হয়। এরূপ এক দেশের এককের মাধ্যমে মানচিত্রে কেন প্রকাশ হলে ভাষাগত কারণে তা অন্য দেশের লোকের কাছে ব্যবহার যোগ্য হবে না। এ অসুবিধা নূর করার জন্য প্রতিভূ অনুপাত পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে। ইংরেজিতে একে Representative Fraction বা সংক্ষেপে R.F. এবং বাংলার সংক্ষেপে প্র.অ. বলে। ভগ্নাংশের আকারে দেওয়া ফেলটির লব রাশি মানচিত্রের দূরত্ব এবং হর রাশি একই এককে ভূমির দূরত্ব প্রকাশ করে।
উদাহরণস্বরূপ ১ সেন্টিমিটারে ১ মিটার বর্ণনায় প্রকাশিত স্কেলটিকে প্রতিভূ অনুপাতে প্রকাশ করতে হলে মিটারটিকে সেন্টিমিটারে আনতে হবে এবং উভয় সংখ্যার মধ্যে অনুপাত চিহ্ন (:) দিতে হবে। ১ মিটার সমান ১০০ সেন্টিমিটার। সুতরাং লব রাশি ১ এবং হর রাশি ১০০। এক্ষেত্রে ক্ষেপটি ১:১০০ বা ১/১০০।
অর্থাৎ এর অর্থ মানচিত্রের সূরত্ব যখন ১ সেন্টিমিটার তখন ভূমির দূরত্ব ১০০ সেন্টিমিটার।
আবার ব্রিটিশ পদ্ধতিতে ১:৩৬ প্র.অ. দেওয়া থাকলে বুঝতে হবে মানচিত্রের দূরত্ব যখন ১ ইঞ্চি তখন ভূমির দূরত্ব ৩৬ ইঞ্চি বা ১ গজ। অতএব বর্ণনায় ১ ইঞ্চিতে ১ গজ। বর্ণনায় যখন ১ ইঞ্চিতে ১ মাইল, তখন প্র.অ. ১:৬৩৩৬০ যেহেতু ১ মাইল = ৬৮৩৩৬০ ইঞ্চি।
একটি বৃহদাকার দেশ ও মহাদেশকে আমরা একটি ছোট বই বা খাতার পৃষ্ঠায় অঙ্কন করে দেখাতে পারি। এছাড়া মানচিত্রটির সঙ্গে ভূমির প্রকৃত দূরত্বটি বোঝানোর জন্য স্কেল ব্যবহার করে ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারি। মানচিত্র বললেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে একটি দেশ, একটি অঞ্চল তথা একটি ভূখণ্ডের চিত্র বা একটি মহাদেশ বা সমগ্র পৃথিবী। একটি মানচিত্রের মধ্যে কতকগুলো সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে মহাদেশটিতে কতটি দেশ এবং একেকটি দেশের মধ্যে কতটি প্রদেশ, বিভাগ, জেলা, রাস্তা, মन-मनী, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি দেখাতে পারি। এভাবে একটি দেশ ও মহাদেশের মধ্যে আমরা চাইলে ছোট একটি স্থানকেও সাংকেতিক চিহ্নের মাধ্যমে দেখিয়ে দিতে পারি। সর্বোপরি বলা যায়, কোনো স্থানের অবস্থান থেকে শুরু করে ঐ স্থানের খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য মানচিত্রের কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং, বলা যায় খুব কম সময়ে সহজ উপায়ে ঘরে বসে সারা বিশ্বকে জানার জন্যই মানচিত্রের উৎপত্তি। একটি মানচিত্রের মধ্যে কী ধরনের তথ্য থাকবে তা নির্ভর করবে- (ক) ভেল, (4) অতিক্ষেপ, (গ) কনভেনশনাল সাইন, (খ) মানচিত্র অঙ্কনকারীর দক্ষতা এবং (8) মানচিত্র অঙ্কনের ধরনের উপর। একটি বৃহৎ ভেলের মানচিত্রের মধ্যে একটি স্থানকে বেশি তথ্য দিয়ে দেখানো যায়।
মানচিত্র অঙ্কন করার জন্য তোমার কিছু বিষয় জানতে হয়। মানচিত্র বিভিন্ন রকমের হয়। প্রতি মানচিত্রেই বিভিন্ন বিষয় থাকে। এগুলো বিভিন্ন রং, রেখা ও সংকেত দিয়ে বোঝানো হয়। এই রং, রেখা ও সংকেত হলো মানচিত্রের ভাষা। মানচিত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এসব ভাষা সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি। আধুনিক সভ্যতায় মানচিত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ইতিহাসবিদ, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক,
সৈনিক ও নাবিকদের নিকট মানচিত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভূগোলবিদ ও ভূগোলের শিক্ষার্থীদের নিকট মানচিত্র একটি অপরিহার্য উপাদান।
আরও দেখুন...